বৈশ্বিক মহামারী কভিড-১৯ প্রভাবে চলতি বছরের মার্চে বড় ধাক্কা লাগে বাংলাদেশ থেকে পণ্য রফতানিতে। এপ্রিলে গিয়ে ব্যাপক হারে কমে যায় রফতানি। তবে মে থেকে রফতানি পরিস্থিতির উন্নতি শুরু হয়। এরপর জুলাইয়ে ইতিবাচক ধারায় ফিরেছে রফতানি।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) থেকে সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে রপ্তানী উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) প্রতিবেদন বলছে, চলতি বছরের জুলাইয়ে বাংলাদেশ থেকে রফতানি হয়েছে ৩৯১ কোটি ৯ লাখ ২০ হাজার ডলারের পণ্য, যা গত বছরের একই সময়ে ছিল ৩৮৮ কোটি ৭৮ লাখ ৬০ হাজার ডলার। এ হিসেবে রফতানি বেড়েছে শূন্য দশমিক ৫৯ শতাংশ।
করোনার প্রভাবে চলতি বছরের মার্চে রফতানিতে প্রথম ধাক্কা লাগে। ওই মাসে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় রফতানি কমে ১৮ দশমিক ২৯ শতাংশ। এরপর এপ্রিলে কমে ৮২ দশমিক ৮৫ শতাংশ। আর মে মাসে কমে ৬১ দশমিক ৫৭ শতাংশ। জুনেও রফতানি কমার ধারাবাহিকতা বজায় থাকলেও ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধির হার ছিল আগের তুলনায় কম, ২ দশমিক ৫ শতাংশ। তবে জুলাইয়ে রফতানি প্রবৃদ্ধি ছিল ধনাত্মক। প্রবৃদ্ধির হার শূন্য দশমিক ৫৯ শতাংশ।
ইপিবির পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা যায়, কেবল ডিসেম্বর ছাড়া গত ২০১৯-২০ অর্থবছরের আগস্ট থেকে জুন সব মাসেই রফতানি প্রবৃদ্ধি নেতিবাচক ছিল। অবশেষে ছয় মাস পর জুলাইয়ে রফতানিতে ধনাত্মক প্রবৃদ্ধির মুখ দেখা গিয়েছে।
ইপিবির হালনাগাদ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বরাবরের মতোই জুলাইয়েও মোট রফতানির সিংহভাগই ছিল তৈরি পোশাক। ওই মাসে মোট রফতানিতে তৈরি পোশাকের অংশ ছিল প্রায় ৮৩ শতাংশ। আর এ পণ্যের রফতানি বৃদ্ধি ও হ্রাস প্রভাব ফেলেছে মোট রফতানিতে। চলতি অর্থবছরের জুলাইয়েও পণ্যটির ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধির হার ২ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে।
এদিকে বিজিএমইএর তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের জুলাইয়ে তৈরি পোশাক (নিট ও ওভেন) রফতানি হয়েছে ৩২৪ কোটি ৪৯ লাখ ৪০ হাজার ডলারের। গত অর্থবছরের জুলাইয়ে রফতানি হয়েছে ৩৩১ কোটি ৪ লাখ ৮০ হাজার ডলারের। এ হিসেবে রফতানি কমেছে ১ দশমিক ৯৮ শতাংশ।
এক অর্থবছর বিবেচনায় ২০১৮-১৯ অর্থবছরে পোশাক পণ্যের মোট রফতানি ছিল ৩ হাজার ৪১৩ কোটি ৩২ লাখ ডলারের। ২০১৯-২০ অর্থবছরে পোশাক রফতানি হয়েছে ২ হাজার ৭৮৩ কোটি ৪০ লাখ ডলারের। এ হিসেবে সদ্যসমাপ্ত অর্থবছরে তৈরি পোশাকের রফতানি কমেছে ১৮ দশমিক ৪৫ শতাংশ।
চীনের উহানে কভিড-১৯-এর প্রাদুর্ভাব দেখা দেয় গত ডিসেম্বরের শেষে। ফেব্রুয়ারি থেকে মার্চের মধ্যে তা বিশ্বের অধিকাংশ দেশে ছড়িয়ে পড়ে। করোনার প্রভাবে দেশের তৈরি পোশাক খাত প্রথমে কাঁচামালের সরবরাহ সংকটে পড়ে। কারণ দেশে তৈরি পোশাক খাতের ওভেন পণ্যের আনুমানিক ৬০ শতাংশ কাপড় আমদানি হয় চীন থেকে। দেশটি থেকে নিট পণ্যের কাঁচামাল
আমদানি হয় ১৫-২০ শতাংশ। পরবর্তী সময়ে ধীরগতিতে হলেও কাঁচামাল সরবরাহ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করলেও রফতানি গন্তব্যগুলোয় চাহিদার সংকট তৈরি হয়।
বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের প্রধান রফতানি গন্তব্য আমেরিকা ও ইউরোপের প্রতিটি দেশই কভিড-১৯-এর ব্যাপক প্রাদুর্ভাব মোকাবেলা করছে। এ অবস্থায় একের পর এক ক্রয়াদেশ বাতিল ও স্থগিত করেছে ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো। বিজিএমইএ বলছে, বাতিল-স্থগিত হওয়া ক্রয়াদেশ ৭৫ শতাংশই পুনর্বহাল হলেও সেগুলোর সময়সীমা নিয়ে প্রশ্ন রয়ে গেছে। কারখানা মালিকরা বলছেন, বাতিল বা স্থগিত হওয়া ক্রয়াদেশগুলোর কিছু ফিরে এসেছে। আবার নতুন ক্রয়াদেশও পেতে শুরু করেছে কারখানাগুলো। কিন্তু তা স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে অনেক কম।
বিজিএমইএর ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মোহাম্মদ আবদুস সালাম বণিক বার্তাকে বলেন, গত বছরের জুলাইয়ে যে পরিমাণ রফতানি হয়েছিল, তা ছুঁতে পেরেছি এ বছরের জুলাইয়ে। এটা আমাদের জন্য বেশ স্বস্তির। টিকে থাকার জন্য আস্থা বেড়েছে আমাদের। আমরা সবাই ২৬ মার্চ থেকে ভয়ানক চিন্তিত ছিলাম। এর মধ্যে প্রায় ২০০ ক্রেতা প্রতিষ্ঠান দেউলিয়া ঘোষণার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। এ রকম একটা পরিস্থিতিতে সরকারের সহায়তা নিয়ে আমরা এগিয়ে যেতে পেরেছি। এখন যে ক্রয়াদেশগুলোর কাজ চলছে, সেগুলো করোনার আগেই পেয়েছিলাম। সেগুলো পুনর্বহাল হওয়াতে এখন রফতানি হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের পোশাকের খুচরা বিক্রয়কেন্দ্রগুলোর বিক্রি গত বছরের এপ্রিলের তুলনায় চলতি বছরের এপ্রিলে ৮৭ শতাংশ কমেছে। মে মাসে কমেছে ৬৩ দশমিক ৩৬ শতাংশ—এমন তথ্য জানিয়ে বিজিএমইএ প্রতিনিধিরা বলছেন, আমাদের হিসাব অনুযায়ী বর্তমানে কারখানাগুলোর গড় সক্ষমতার ৫৫ শতাংশের মতো ক্রয়াদেশ আছে, যা বছর শেষে বাড়তে পারে। ২০২০-এর ডিসেম্বরের মধ্যে সক্ষমতার ৭০ শতাংশ ক্রয়াদেশ হতে পারে। এ ধরনের অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে দীর্ঘমেয়াদি ভবিষ্যদ্বাণী বাস্তবসম্মত না-ও হতে পারে, তার পরও ২০২১ সালের মাঝামাঝি সময়ে নিয়মিত রফতানির ৮০ শতাংশ হবে এমন আশা করছেন বিজিএমইএ নেতারা।
পোশাক খাতের আরেক সংগঠন বিকেএমইএর সাবেক সভাপতি ফজলুল হক বলেন, সামগ্রিক প্রবৃদ্ধি খুবই ভালো। জুলাইয়ে বড় উল্লম্ফন খাতের পুনরুদ্ধারকে ইঙ্গিত করে। পাশাপাশি সরকারের ঋণ সহায়তা প্যাকেজের সফলতাও। তবে আগস্ট-সেপ্টেম্বরে রফতানি আবারো কমে যেতে পারে বলে আশঙ্কাও প্রকাশ করেন তিনি।
ইপিবির পরিসংখ্যান বলছে, জুলাইয়ে ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়েছে এমন খাতের মধ্যে আছে পাট ও পাটজাত পণ্য। এ পণ্যের রফতানি বেড়েছে ৩৮ দশমিক ২৩ শতাংশ। এছাড়া কৃষিজাত পণ্যের রফতানি প্রবৃদ্ধি জুলাইয়ে ছিল ৩০ দশমিক ৯২ শতাংশ।
সুত্রঃ বণিকবার্তা
0 Comments